কেরিয়ার গড়তে এআই

বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর বেশিরভাগ পড়ুয়াই ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে কেরিয়ার গড়ার স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ক্ষেত্র অনেক বড়। তাহলে কোন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করবেন? এই নিয়ে চিন্তায় প্রায় নাওয়া-খাওয়া ভুলতে বসেন পড়ুয়া থেকে পরিবারের লোক। কারণ, পড়াশোনা করে চাকরি পেতে হবে। পড়াশোনা করা হল, কিন্তু চাকরি অধরা থেকে গেল, এমনটা হলে তো মুশকিল। প্রতিনিয়ত পৃথিবী বদলাচ্ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বদলাচ্ছে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শাখা।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ ছোট করে ‘এআই’  বর্তমানে একে নিয়েই চলছে চর্চা।  বলা হচ্ছে, পৃথিবীর ভবিষ্যত্ এই স্বয়ংক্রিয় বুদ্ধিমত্তা। তাই এই বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করার ঝোঁকও বাড়ছে। দেশ ও রাজ্যের সরকারি থেকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির প্রায় সমস্ত জায়গাতেই এখন এই বিষয়টি সিলেবাসের মধ্যে রাখা হচ্ছে। যদিও বিদেশে একেবারে স্বয়ংক্রিয় বুদ্ধিমত্তা নিয়েই অনেক প্রতিষ্ঠানে পড়ানো হয়। দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতেও ধীরে ধীরে সেরকম ব্যবস্থা আসা শুরু হচ্ছে।
স্বয়ংক্রিয় বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ আজকের দিনে সমস্ত জায়গায় ব্যবহার হওয়া শুরু করেছে। স্বাস্থ্যক্ষেত্র, শিক্ষা থেকে শুরু করে ব্যবসা ও অটোমোবাইল পর্যন্ত সমস্ত ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। নানা ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার আমাদের জীবনকেও তাই আগের চেয়ে অনেক সহজ করে তুলেছে।
এই নতুন প্রযুক্তিকে প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রই দ্রুত গ্রহণ করতে শুরু করেছে। হাল আমলে ভোট প্রচারে রাজনীতির ময়দানেও শুরু হয়েছে স্বয়ক্রিয় বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার। টেলিভিশন কিংবা খবরের কাগজের কাজ কর্মেও ব্যবহার হচ্ছে এই এআই প্রযুক্তি। এআই দ্বারা নির্মিত সঞ্চালকের ব্যবহার ইতিমধ্যেই দেশের সংবাদ মাধ্যমে দেখা গিয়েছে। এআই প্রযুক্তির ব্যবহার সাম্প্রতিক সময়ে নিত্যদিনের জীবনেও প্রবেশ করছে। ব্যাঙ্কিং, ট্রেডিং, ই-কমার্স, সার্চ ইঞ্জিনের ক্ষেত্রেও এআই প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে। এআই পাঠক্রমের ভবিষ্যত্ কী? এই নিয়ে কথা হচ্ছিল ম্যাকাউট-এর প্রাক্তন উপাচার্য সৈকত মিত্রের সঙ্গে। তিনি জানালেন, ‘চাকরির বাজারে এআই নিয়ে পড়াশোনা করা ছেলেমেয়েদের সুযোগ বাড়ছে। শুধু এ রাজ্য নিয়ে অন্যান্য রাজ্যেও চাকরির বাজার প্রস্তুত। ফলে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যেও  ক্ষেত্রে এআই নিয়ে পড়াশোনার ঝোঁক আছে। কম্পিউটার নিয়ে পড়াশোনা করলেই এআই নিয়ে এগনো যাবে। সব ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজেই এখন এআই পাঠক্রমের চালু হচ্ছে। এই বিষয়টি সেই কম্পিউটার সায়েন্সের মধ্যেই তো পড়ে।’
শিক্ষাবিদরা বলছিলেন, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের প্রতিষ্ঠান যেমন, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি একদম নির্দিষ্টভাবে পড়ায়। যেটুকু একজন পড়ুয়া চাইছে, সেইটুকুই পড়ানো হয়। আমাদের দেশেও ধীরে ধীরে সেই পথেই হাঁটতে যাচ্ছে। এআই, ডেটা সায়েন্স, মেশিন লার্নিংয়ের বিষয়ে দেশের বুকে চাকরির সুযোগ অনেকটাই বাড়ছে। বিভিন্ন সমীক্ষা বলছে, ২০১৯ সালে এআই আসার পর থেকে চাকরির সুযোগ অনেকটাই বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন, ২০২৫ সালের মধ্যে শুধুমাত্র ভারতেই প্রায় ৩ লক্ষ এআই কেন্দ্রিক চাকরি তৈরি হবে । কারণ, এই ক্ষেত্রে যে হারে বিনিয়োগ বাড়ছে, তার ভিত্তিতেই অনুমান করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনও একটি ক্ষেত্রে চাকরির সুযোগ কমতে থাকলেই আর একটা দরজা খুলে যায়। এক্ষেত্রে এআই সেই কাজ করেছে। সেই সূত্র ধরেই এআই ডেভেলপমেন্ট, ডেটা সায়েন্স, সাইবার সিকিউরিটি, রোবটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের চাহিদা বাড়ছে। দেখা যাচ্ছে এই মুহূর্তে ভারতে এআইয়ের প্রভাব সবচেয়ে বেশি তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে। এখানে প্রায় ২৬ শতাংশ ক্ষেত্রে ভাগ বসিয়েছে এআই। এর পরেই আসে শিক্ষা। সেখানেও ১৪ শতাংশ ভাগ বসিয়েছে এআই। অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে, এআই কেন্দ্রিক চাকরির সুযোগ সারা পৃথিবীর সঙ্গে দেশেও বৃদ্ধি পেতে চলেছে। কিন্তু এর জন্য দেশের মধ্যে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে দরকার সঠিক পরিকাঠামো। রবোটিক্স, মেশিন লার্নিং পরবর্তী এআই কেন্দ্রিক বিষয়গুলি পড়াতে গেলে পরিকাঠামো অত্যন্ত জরুরি। তার পাশাপাশি যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষকেরও দরকার।
কীভাবে এআই নিয়ে পড়াশোনা?
এআই ইঞ্জিনিয়ার ক্ষেত্রে প্রবেশের জন্য প্রথম প্রয়োজন হল হাইস্কুল স্তরে রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, গণিত-সহ সায়েন্স নিয়ে পড়া। স্ট্যাটিসটিক্স থাকলেও হবে।
চার বছরের ব্যাচেলর অব টেকনোলজি বা বিটেক  ডিগ্রির বদলে তথ্য প্রযুক্তি বা কম্পিউটার বিজ্ঞানের মতো বিষয়ে ব্যাচেলর অব সায়েন্স বা বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বিশেষজ্ঞ হওয়া সম্ভব। তবে আলাদা করে শিখতে হবে ডেটা সায়েন্স এবং মেশিন লার্নিং। এর পরে এআই ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করতে হবে। এছাড়া, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কোর্স বা ডিপ্লোমা প্রোগ্রামগুলির মাধ্যমেও কম খরচে এআই বিশেষজ্ঞ হিসেবে কেরিয়ার গড়া যায়। এআই এবং মেশিন লার্নিং-এ স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের সুযোগও রয়েছে।
একজন এআই ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য, ডিগ্রির পাশাপাশি বাস্তব অভিজ্ঞতাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাস্তব-পৃথিবীর সমস্যাগুলির সঙ্গে হাতে-কলমে অভিজ্ঞতা থাকা ডিগ্রির সমান গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন প্রকল্পে অংশগ্রহণের মাধ্যমে এবং হ্যাকাথনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে, আপনি ব্যবহারিক ক্ষেত্রে আপনার অভিজ্ঞতা বাড়াতে পারেন, দক্ষতার বিকাশ ঘটাতে পারেন। এআই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি এবং প্রযুক্তির অভিজ্ঞতাও লাগবে। উপরন্তু, অনলাইন কোর্স এবং বুটক্যাম্পগুলি আপনাকে বাস্তব-পৃথিবীর প্রকল্পগুলিতে কাজ করার এবং এই ক্ষেত্রের পেশাদারদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের সুযোগ দেয়। তাত্ত্বিক জ্ঞান এবং ব্যবহারিক অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণেই একজন দক্ষ এআই ইঞ্জিনিয়ার হওয়া যায়।
এছাড়া, বেড়েছে এই বিষয় সম্পর্কিত চাকরির সুযোগও, যেখানে বেতন কাঠামো আকর্ষণীয়। তাই এ বার ঝটপট চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক এই বিষয়ের নানা দিকে।
কোন কোন পেশা নির্বাচন করতে পারেন?
সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার: এক জন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারকে নানা প্রোগ্রাম তৈরি করতে হয় যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিভিন্ন টুল কাজ করে। তাঁদের প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ও কম্পিউটার অপারেটিং সিস্টেমে বিষয়ে জ্ঞান থাকতে হয়। ইঞ্জিনিয়ারিং-এর শিক্ষাকেই এঁরা সফটওয়্যার বানানোর সময় কাজে লাগান।
বিগ ডেটা অ্যানালিস্ট: বিগ ডেটা অ্যানালিস্টদের কাজ হল বিভিন্ন পুরোনো ডেটা থেকে একটি অর্থপূর্ণ ধরন খুঁজে বের করা, যা দেখে ভবিষ্যত সম্বন্ধে খানিকটা আন্দাজ করা যায়। ডেটা অ্যানালিস্ট হিসাবে বিভিন্ন প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ ও টুলস সম্পর্কে অবহিত হতে হয় এবং ডেটা মাইনিং ও ডেটা অডিটিং-এর ধারণা থাকতে হয়।
গবেষক: বৈজ্ঞানিক গবেষকরা ফলিত গণিত, মেশিন লার্নিং, ডিপ লার্নিং এবং গণনামূলক পরিসংখ্যানবিদ্যায় দক্ষ হয় এবং গবেষণাগারে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা চালায়। এঁদের কম্পিউটার সায়েন্স বা এই সম্পর্কিত কোনও বিষয়ে কোনও উচ্চশিক্ষার ডিগ্রি থাকতে হয়।
বিজনেস ইন্টেলিজেন্স ডেভেলপার: বিজনেস ইন্টেলিজেন্স ডেভেলপারদের মূল কাজ হল ডেটা অ্যানালেটিক্স ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়িক ও বাজার সম্পর্কিত বিভিন্ন ট্রেন্ড পর্যালোচনা করা। এ ছাড়াও, তাঁরা কোম্পানির বিভিন্ন সফ্টওয়ার তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণ করে ব্যবসায়িক কৌশলগুলি ঠিক করে। এই পেশার চাহিদা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে, এখন প্রতিটি ডেটা-নির্ভর সংস্থাতেই এমন লোকের প্রয়োজন রয়েছে যাঁদের বিজনেস ইন্টালিজেন্স নিয়ে জ্ঞান আছে।
রোবটিক্স ইঞ্জিনিয়ার: আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সে রোবোটিক্সের ব্যবহার শুরু হওয়ার পর এখন উল্লেখযোগ্য শিল্পক্ষেত্রে নানা যন্ত্রাংশের প্রোগ্রামিংয়ের জন্য রোবটিক্স ইঞ্জিনিয়ারের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এঁদের মূলত বিভিন্ন রোবট বা রোবটিক ব্যবস্থার সৃষ্টি, নির্মাণ, পরীক্ষানিরীক্ষার কাজগুলি করতে হয়। এই রোবটিক ব্যবস্থাগুলি আসলে মানুষের দ্বারা যে কাজগুলি করা সম্ভব নয়, সেগুলি সম্পন্ন করতে সাহায্য করে।
একজন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ইঞ্জিনিয়ারের বেতন কাঠামো আনুমানিক বার্ষিক ৮.৮ লক্ষ টাকা। এই ক্ষেত্রে চাকরির চাহিদার সঙ্গে উন্নতিরও প্রচুর সম্ভাবনা থাকে আর তাই এ ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতাও বেশ কঠিন হয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here