মোহনবাগান নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরগরম ময়দান। সবুজ-মেরুনে নির্বাচন বারবার পেয়েছে অন্য মাত্রা। ময়দানি সমীকরণ হোক কিংবা কয়েকটি ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ মোহনবাগানের নির্বাচনকে বরাবরই আইডেনটিক্যাল করে তুলেছে। কিন্তু সেই নির্বাচনের উত্তাপ কখনওই মোহনবাগানের সংস্কৃতিকে খর্ব করেনি। কিন্তু বর্তমান বিরোধী শিবিরে থাকা শিশির ঘোষ যে কদর্য ভাষায় বুধবার হাওড়ার সভা থেকে বর্তমান সচিবকে আক্রমণ করলেন তা সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে যায়। কর্ম জীবনে সফল হলেই যে ‘মানুষ’ হওয়া যায় না তার আদর্শ উদাহরণ। মোহনবাগান নির্বাচনে লড়ছেন অথচ সেই মোহনবাগানের সংস্কৃতি-কৌলিন্যকেই কালিমালিপ্ত করছেন প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করতে গিয়ে এমন নমুনার জুড়ি মেলা ভার। যেই টুটু বসু-সৃঞ্জয় বসুর সমর্থনে তিনি প্রচার সভায় মাইক্রোফোন হাতে সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন সেই মোহনবাগানের নির্বাচণের ইতিহাস কতটুকু জানেন?
১৯৯০ সালে ধীরেন দে’র শিবিরের বিরুদ্ধে গৌর সাহার নেতৃত্বে যেই শিবির নির্বাচনে লড়েছিল সেই শিবিরে ছিলেন টুটু বসু-অঞ্জন মিত্র। শেষ পর্যন্ত গজু বসু এবং সুশোভন বসুর হস্তক্ষেপে নির্বাচন হলেও তৈরি হয়েছিল মিলিঝুলি প্যানেল। নতুন তৈরি কমিটিতে ধীরেন দে-ই ছিলেন সচিব এবং সহ-সচিব হন গোবিন্দ দে। তাঁর প্রতিপক্ষ হিসেবে থাকা টুটু বসু এবং অঞ্জন মিত্র ছিলেন এক্সিকিউটিভ কমিটিতে। পরবর্তীতে গোবিন্দ দে সহ-সচিবের পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ায় নতুন সহ-সচিব হন টুটু বসু। উমাপতি কুমারের প্রয়াণের পর সচিব পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে সভাপতি হন ধীরেন দে। এক্সিকিউটিভ কমিটির সিদ্ধান্তে নতুন সচিব হন টুটু বসু। টুটু বসু সাধারণ সদস্য হিসেবে প্রথমে এক্সিকিউটিভ কমিটিতে এলেও অঞ্জন মিত্র হিসেবরক্ষক হিসেবে এসেছিলেন সেই কমিটিতে। এর মাঝে ১৯৯৩ সালে প্রয়াত হন ধীরেন দে। তার পর থেকেই ফাঁকা ছিল মোহনবাগানের সভাপতির পদ। নিজের টার্ম শেষ করে ১৯৯৫ সালে সচিব পদ থেকে সরে আসেন টুটু বসু এবং দীর্ঘ ২০ মাস ফাঁকা থাকা মোহনবাগানের সভাপতি পদের দায়িত্ব তিনি গ্রহণ করেন। এই সময়ে সচিব পদে আসেন ফুটবল সচিব থেকে সহ-সচিব হওয়া চুনী গোস্বামী। কিন্তু তিনি দায়িত্ব নিয়ে ১৯৯৫ সালে বৃদ্ধাশ্রমে পরিণত করেন মোহনবাগান দলকে। দলের খারাপ পারফরম্যান্সে সচিবের দায়িত্ব থেকে অব্যহতি নেন চুনী গোস্বামী। হিসেবরক্ষক থেকে মাঝের কিছু মাস সহ-সচিব থাকা অঞ্জন মিত্র এই সময় নতুন সচিব হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
এ বার আসা যাক ২০০৫-এর নির্বাচনের প্রসঙ্গে। অঞ্জন মিত্র যখন সচিব হলেন তখন বলরাম চৌধুরি ক্রিকেট সচিব থেকে এলেন সহ-সচিব পদে। ১৯৯৫ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ক্লাবের দখলদারী কিংবা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ঠাণ্ডা লড়াই শুরু হয় অঞ্জন মিত্র-টুটু বসুর সঙ্গে বলরাম চৌধুরি-কেষ্ট সাহার। ক্লাবের চেক সইয়ের সিগনেটারি সেই সময়ে ছিলেন কেষ্ট সাহা, বলরাম চৌধুরি, ওম ঝুনঝুনওয়ালা এবং অঞ্জন মিত্র। চেক ক্লিয়ার করতে হলে অন্তত তিন জনকে সই করতে হত। কেষ্ট সাহা আগেই চেক সই করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন পরে বন্ধ করে দেন বলরাম চৌধুরিও। এমন অবস্থায় ত্রাতা হিসেবে দেখা দেন টুটু বসু। তিনি দল চালানোর টাকা দিতেন। ১৯৯৮ সালে পল্টু দাস বিজয় মালিয়াকে যখন স্পনসর হিসেবে নিশ্চিত করে ফেলেন তখন ব্যক্তিগত সম্পর্ক খাটিয়ে বিজয় মালিয়াকে নিয়ে আসেন মোহনবাগানে। গজু বসুর ঘনিষ্ঠ মোহনবাগানের ১৯ জন মেম্বর অধিকাংশ ভবানীপুর নিবাসী এর বিরুদ্ধে মামলা করেন এবং তার ফলস্বরূপ রিসিভার বা স্পেশ্যাল অফিসার অফ ফুটবল অ্যাফেয়ার্স হিসেবে এলেন শ্যামল সেন। তিনি এসেই বর্তমান সচিব দেবাশিস দত্তকে দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের দেখভালের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য আহ্বান করেন। সেই সময়ে ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বর থেকে মোহনবাগান ক্লাব করা দেবাশিস ছিলেন ফুটবল কনভেনার। কিন্তু টুটু-অঞ্জনের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে সেই দায়িত্ব প্রত্যাখ্যান করেন দেবাশিস। এর কারণ-ও রয়েছে। টুটু বসুর হাত ধরে মোহনবাগানে প্রবেশ দেবাশিসের। তাঁকে প্রশাসক হিসেবে তৈরির দায়িত্ব নিয়েছিলেন অঞ্জন। পরবর্তীতে বলরাম চৌধুরিকে এই দায়িত্ব দেন শ্যামল সেন। সেই সময়ের মধ্যেই শেষ বার ২০০৩ সালে আইএফএ শিল্ড জেতে মোহনবাগান। পরবর্তীতে ব্যারেটোকে ধরে রাখা, তাঁর বেতন, ‘ভালবাসর পেমেন্ট’, কসবায় ব্যারেটোর ফ্ল্যাটের সামনে হাজার হাজার সমর্থকের ভিড় এবং আরও বেশ কিছু মিলিয়ে মাঝের এক বছর একাধিক কাণ্ড ঘটে এবং শেষ পর্যন্ত শ্যামল সেন নির্বাচন করান ২০০৫ সালে। কেষ্ট সাহা-বলরাম চৌধুরির প্যানেলকে ১২০০ ভোটে হারিয়ে জয়-বীরুর জুটি টুটু-অঞ্জন মোহনবাগানের ক্ষমতায় থাকে। অঞ্জন মিত্র জেতেন ৫৫০-এর বেশি ভোটে।
শুধু শিশির ঘোষের ঘটনাই একমাত্র নয়, মোহনবাগানের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একাধিক ঘটনা ছাড়িয়ে যাচ্ছে শালীনতার সীমা। এর আগে দেবাশিস দত্তের একটি ভাইরাল কল রেকডিং বাজারে ছড়িয়ে পড়ে। সেই রেকডিং-এর সত্যতা যদিও আমরা যাচাই করিনি, তবে সেখানে যে শব্দগুলি ব্যবহার করা হয়েছিল তা কখনওই গ্রহণযোগ্য নয়। নিজের শিবিরের সদস্যকে অভয় দিতে গিয়ে যে শব্দ চয়ন করেছেন তা মোহন সচিবের মানায় না। এর বিরুদ্ধে হাওড়ায় অপর সভা থেকে বিরোধী শিবির মারাত্মক কটাক্ষ করে দেবাশিসকে। তবে, সেই কটাক্ষের ক্ষেত্রেও যে ভাষা প্রয়োগ করা হয়েছিল সেটিও ছিল কটুকথা। এই ঘটনার সমসাময়িক মোহনবাগানের শাসক শিবিরের ঘনিষ্ঠ এক সদস্যের স্ত্রী’কে হুমকি দেওয়া হয় নির্বাচনের মধ্যে বেশি না জড়ানোর জন্য। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে এফআইআর করা হয় উত্তরপাড়া থানায়। সব মিলিয়ে মোহনবাগানের আসন্ন নির্বাচণ উত্তাপের নিরিখে ২০০৫-এর নির্বাচণকে আগেই ছাপিয়ে গিয়েছে কিন্তু যে ভাবে কটুক্তি কিংবা অশালীন শব্দ প্রয়োগ এই নির্বাচনকে ঘিরে দেখা যাচ্ছে তাতে বলতে দ্বিধা নেই সবুজ-মেরুন সঙ্গে এই পরিবেশ সত্যিই বেমানান।